মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায়: মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানুন

মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায়মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতিতে আজ আমরা গৌণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং তৃতীয় ধাপের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করব। মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে আপনারা যারা আমাদের প্রথম পোস্ট পড়েন নি তারা সেই পোষ্টটি পড়ে এই পোস্ট পড়বেন। তাহলে খুব ভালোভাবে মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বুঝতে পারবেন।

আগের পোস্টটি পড়তে ক্লিক করুন: মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির উপায়

মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে গৌণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা:

মুখ্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্যর্থ হলেই গৌণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন হয়। প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ শনাক্ত করা এবং রোগীকে তার এলাকায় রেখেই মানসিক চিকিৎসা ব্যবস্থা করার যে প্রক্রিয়া তা হচ্ছে গৌণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। মহামারী সংক্রান্ত গবেষণা যেমন শারীরিক রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কোন এলাকায় এই ধরনের সমস্যা বেশি হচ্ছে, কেন এ ধরনের সমস্যার উৎপত্তি হয়েছে বা কিসের মাধ্যমে এর ব্যাপকতা বাড়ছে এ সম্পর্কে তথ্য জানা থাকলে, সমস্যা বহুলাংশে রোধ করা যায়। আমরা জানি যে, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অর্থনৈতিক সমস্যা, দ্রুত সামাজিক পরিবর্তন, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি কারণে ব্যক্তির ওপর প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয় এবং বিশেষ বিশেষ এলাকায় ব্যাপক হারে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। এ সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য জানা থাকলে তা মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে কাজ করে।

গৌণ প্রতিরোধের জন্য এলাকাভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপনের নানাবিধ সুবিধা রয়েছে।

প্রথমত: চিকিৎসাব্যবস্থা সহজলভ্য হয়ে যাবে অর্থাৎ রোগীর গৃহের দ্বারপ্রান্তে চিকিৎসাব্যবস্থা পৌঁছে যাবে। এর ফলে রোগী এবং তার পরিবার খুব সহজেই সাইকোলজিস্ট বা মনোচিকিৎসকের সাহায্য নিতে পারবে।

দ্বিতীয়তঃ রোগী যদি স্বেচ্ছায় বা নিজের ইচ্ছায় মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে না যায়, তবে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মীগণ রোগীর বিষয়ে ব্যবস্থা করতে পারবেন।

মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির জন্য নিম্নোক্ত সেবা দিতে পারবে:

 মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির উপায়

১. সার্বক্ষণিক চিকিৎসা-সুবিধা: স্বল্প দিনের জন্য রোগীকে সার্বক্ষণিকভাবে মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে রেখে তার চিকিৎসার সুব্যবস্থা করে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে।

২. আংশিক চিকিৎসা সুবিধা: স্বল্প সময়ের জন্য স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সুবিধা দেওয়া যায়। যেমন, রোগী সারাদিন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে থেকে রাত্রে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ত্যাগ করতে পারে। অথবা সারারাত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে থেকে দিনের বেলা কাজকর্ম করার জন্য সে বের হতে পারে।

৩. স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বহিঃ বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় ঔষধ এবং পরামর্শ গ্রহণ করে রোগী পরিবারে বসবাস করতে পারে এবং তার কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারে।

৪. জরুরী সেবা: যেকোনো জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য, মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহায্য সহজেই পাওয়া যায়।

৫. পরামর্শ ও শিক্ষাদান: মানসিক রোগের প্রতিরোধ সম্পর্কে এলাকার জনগণকে স্বাস্থ্যকর্মীরা পরামর্শ ও শিক্ষাদান দিতে পারেন। যা মানসিক রোগ থেকে মুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

মানসিক রোগ থেকে মুক্তির জন্য সংকট নিরসনে হস্তক্ষেপ:

যখন কোন ব্যক্তি পরিবারের তীব্র মানসিক চাপের মুখে সম্পূর্ন অসহায় হয়ে পড়ে, তখন তাদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা বা সাহায্য না দিলে অপূরণীয় ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। মূলত দুইভাবে এদের সাহায্য করা যায়। প্রথমত, তাদের আবেগ মূলক সহায়তা দেয়া হয় এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য পরামর্শ এবং তথ্য দেয়া হয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আবেগ কিছুটা প্রশমিত হলেই তার পক্ষে মানসিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সহজ হয়।

দ্বিতীয়ত, টেলিফোন লাইনের ব্যবস্থা করা:  রোগী মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে পারেন। স্বাস্থ্যকর্মী টেলিফোনেই পরামর্শ দিয়ে তাদের উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত করার চেষ্টা করবেন এবং যত দ্রুত সম্ভব রোগীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করবেন এবং তার মানসিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবেন। ফলে তার মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতি ঘটবে।

বিশেষ করে সন্তানের সঙ্গে যখন পিতা-মাতার কথাকাটাকাটি বা আরও গুরুতর কিছু হয়, তখন সন্তান অতি আবেগি বা উত্তেজিত হয়ে যায়। এ সময় মনোবিজ্ঞানী বা সাইকোলজিস্ট এর পরামর্শ নেওয়া তার একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়।

মূলত এভাবে আমরা গৌণ প্রতিরোধ করতে পারি এবং রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারি।

মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে তৃতীয় ধাপের প্রতিরোধ ব্যবস্থা:

গৌণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যদি ব্যর্থ হয়ে যায় তখন তৃতীয় ধাপের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন হয়। মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাময়িক চিকিৎসায় যদি রোগ নিরাময় না হয় এবং রোগ যদি জটিল আকার ধারণ করতে থাকে, তখন সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে মানসিক হাসপাতালে প্রেরণের ব্যবস্থা করতে হয়। এসব রোগীর রোগ নিরাময়ের জন্য মানসিক হাসপাতালের সুনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ এবং অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান ও চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। তবে হাসপাতালে রোগীর অবস্থান যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয় বরং সংক্ষিপ্ত হয়, সেদিকে নজর রাখা প্রয়োজন। কারন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরবর্তী মানসিক হাসপাতালে অবস্থান রোগীর জন্য চাপ সৃষ্টি করে। তেমনি তা তার পরিবার পরিজনদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া মানসিক হাসপাতালে রোগীর অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলে রোগী হাসপাতালে উন্নত পরিবেশ ও জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। তাই পরবর্তীতে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। ফলে তারা পুনরায় আবার মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। সুতরাং হাসপাতালে অবস্থানরত মানসিক রোগীদের যত দ্রুত সম্ভব রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করা হয় এবং তাদের মানসিক অবস্থা মোটামুটি ঠিক হলে তাদের নিজ গৃহে ফেরত পাঠানো হয়।

রোগীর গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর দুইটি বিষয়ের উপর নজর দিতে হয় এবং উভয় ক্ষেত্রেই মানসিক স্বাস্থ্য কর্মী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রথমটি হচ্ছে মানসিক রোগীর পুনর্বাসন এর ব্যবস্থা। মানসিক হাসপাতাল ফেরত ব্যক্তি অস্বাভাবিক ব্যক্তিরূপে সমাজে চিহ্নিত হয়ে পড়ে এবং তার প্রতি মানুষ একটু ভিন্ন ভাব পোষণ করে। মানসিক স্বাস্থ্য কর্মীরা শিক্ষা দানের মাধ্যমে এই মনোভাব দূর করার চেষ্টা করেন। যেন রোগীর স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশের জন্য তার পরিবার এবং এলাকাবাসী তাকে সাহায্য করে। পরিবেশের যে অবস্থা সমূহ রোগীর মানসিক পুনর্বাসনের বাধা সৃষ্টি করে, সেগুলো স্বাস্থ্যকর্মী অপসারণ করার চেষ্টা করে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে,

রোগীর রোগ পরবর্তী পরিচর্যা। মাঝে মাঝে মানসিক রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, তার রোগ পরবর্তী অবস্থা মূল্যায়ন করা এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে রোগীর মানসিক চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া প্রভৃতি এই কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া যেসব পারিপার্শ্বিক অবস্থানগুলো রোগীর উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে সেগুলো অপসারণ করার চেষ্টা করা। এলাকায় অবস্থিত মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যান। তবে প্রয়োজনবোধে স্বাস্থ্যকর্মীরা মানসিক হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং প্রয়োজনীয় কার্যক্রম এর নির্দেশনা পেয়ে থাকেন। রোগ পরবর্তী কার্যক্রম মানসিক রোগ প্রতিরোধে এবং মানসিক রোগের প্রভাব বহুলাংশে রোধ করা যায়।

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানসিক রোগীর রোগ মুক্তি, তাকে সমাজে পুনর্বাসিত করা এবং পরবর্তী পরিচর্যার মাধ্যমে তার মানসিক রোগের প্রভাব হ্রাস করাই হচ্ছে তৃতীয় ধাপের প্রতিরোধ ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য।

আমরা মূলত আমাদের আগের পোস্ট এবং বর্তমান পোস্টে মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায়কিভাবে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতি করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করেছি। আশা করি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আপনাদের ভুল ধারণা গুলো দূর হবে এবং এর উন্নতিতে আপনারা সচেতন হবেন।

মনোবিজ্ঞানমানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের পোস্ট পেতে ভিজিট করুন এখানে

1 thought on “মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায়: মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানুন”

Leave a Comment